মকবুলা পারভীন:
একটি পত্রিকা অফিসে চাকরির সুবাদে এক ভদ্রলোককে দেখতাম, প্রতিদিনই তিনি বিকেলে সেই অফিসে এসে দীর্ঘ সময় কাটাতেন। লেখা নিয়েই আসতেন। সপ্তাহে বা মাসে তার একটি-দু’টি লেখা ছাপা হতো। তার লেখায় মাঝে মাঝে বিতর্কিত কিছু বিষয় যোগ হলে তা ছাপা হতো না। তিনি বলতেন, তিনি বিতর্কিত হতে চান, যদি বিতর্কটা রাষ্ট্র পর্যন্ত যায় তাহলে এ সুবাদে উন্নত দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারবেন- এ জন্য। তার মস্তিষ্কে কিছুটা গোলমাল দেখা দিয়েছে বলেই ধারণা করেছিলাম। একদিন তিনি কিছু সত্য প্রকাশ করলেন। তাতে বুঝা গেল, তিনি মানসিক পীড়নে অসুস্থতার দিকে যাচ্ছেন।
ভদ্রলোক একটি সরকারি অফিসে চাকরি করতেন। দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে রিটায়ার করে তিনি ৬০ লাখ টাকা পান। সেই টাকা পরিবারের জন্য কাজে না লাগিয়ে একটি মাল্টিপারপাস কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। মিষ্টি কথায় লোভ দেখিয়ে তারা টাকাটা নিয়ে একদিন গায়েব হয়ে যায়। সংসার, স্ত্রী-সন্তান সবকিছু উপেক্ষা করে লাভের আশায় ভুল জায়গায় অর্থ বিনিয়োগ করার পরিণতিতে সংসারে দারিদ্র্য তো নামেই সাথে পারিবারিক অশান্তি তীব্র আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় তার মাথায় গোলমাল দেখা দেয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এ ধরনের চিটিংবাজ হায় হায় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে কতজন যে পথের ভিখারি হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। প্রতারকদের দ্বারা সারা দেশের মানুষ কম বেশি প্রতারিত হয়ে আসছেন। লাভের আশায় হতদরিদ্র মানুষও ছাগল, গরু বিক্রি করে, তিল তিল সঞ্চয় দিয়ে প্রতারকদের মিষ্টি কথার জাদুতে আকৃষ্ট হয়ে অধিক লাভের আশায় টাকা তুলে দেয় ওদের হাতে। একদিন চাট্টিবাট্টি গুটিয়ে কোম্পানির অফিস হাওয়া হয়ে যায়। মরণ নেমে আসে নিরীহ মানুষজনের ওপর। তারা প্রতিকার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও প্রতিকার পায় না। এইভাবে চাকরিদাতা সেজেও প্রতারকরা মানুষের কাছ থেকে জামানত নিয়ে উধাও হয়ে যায়। এ জন্যই এ ধরনের কোম্পানির নাম হয় ‘হায় হায়’ কোম্পানি। অর্থ হাতিয়ে নেয়ার আগে তারা কথার ফুলঝুরি ছোটায়, আঠার মতো লেগে থাকে পেছনে, স্বার্থ উদ্ধার হলেই দেয় ‘ডুব’।
প্রতারকরা ট্রেনিং দিয়ে একদল লোক তৈরি করে যাদের বাচনভঙ্গি মানুষকে চমৎকৃত করে, মোটিভেট করে। চেহারা, সাজপোশাক চৌকস। বিশালবহুল অফিস খুলে, বিস্তর আশার বাণী শুনিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে থাকে। এমনকি ধর্মকে ব্যবহার করেও তারা প্রতারণা করে থাকে। সম্প্রতি নরসিংদীর একটি মাল্টিপারপাস কোম্পানির এমন প্রতারণাকাণ্ডে চেয়ারম্যানসহ পাঁচজনকে র্যাব আটক করেছে বলে জানা গেছে। র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, ‘সমবায় অধিদফতর থেকে নিবন্ধন নিয়ে ২০১০ সালে নরসিংদী সদরের চিনিশপুর ইউনিয়নে প্রথমে এই কোম্পানির কাজ শুরু হয়। সমিতির পরিষদে থাকা ২০ জনের ছিল শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতা।
তারা নিজেদের পরিচিতি কাজে লাগিয়ে এমএলএম ব্যবসা শুরু করেন। টার্গেট অনুযায়ী তারা ওই জেলায় বিভিন্ন শাখা অফিস খুলে আমানত সংগ্রহ করেন। এ জন্য তারা তিন শতাধিক মাঠ কর্মীও নিয়োগ দেন, যাদের মাসিক বেতন না দিয়ে বিনিয়োগকারী সংগ্রহের ভিত্তিতে ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন দেয়া হতো। গ্রাহকদের আমানতের ১২ থেকে ১৬ শতাংশ মুনাফা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হতো। এভাবে ছয় হাজার মানুষের কাছ থেকে তারা ২০০ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছিল। করোনাকালে লোকজন টাকার জন্য কোম্পানিতে ধরনা দিলে তারা অফিসে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যায়। অভিযোগের ভিত্তিতে অবশেষে র্যাব ঊর্ধ্বতন পরিষদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে।
এরপর গ্রাহকদের ভবিষ্যৎ কী নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না। কারণ অতীতেও এ রকম কাণ্ড দেখা গেছে আর টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এভাবে ছোট, মাঝারি, বড় কোম্পানি ভুঁইফোড় জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে আর নিজেদের আখের গুছিয়ে, বিত্তবেসাতি করে তারা হারিয়ে যায়। রয়ে যায় গ্রাহকের বুক চাপড়ানো কান্না ও হাহাকার।
ঘটনাগুলো চোখের আড়ালে হয় না, চোখের সামনেই হয়। একশ্রেণীর চতুর বুদ্ধিমান লোক এ ধরনের ব্যবসায় সমাজের উচ্চস্তরের লোকদেরও মাস কাবারে একটা মোটা অর্থ দিয়ে হাত করে রাখে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত করে হোমড়াচোমড়া ব্যক্তিদের। তাদের দিয়ে গুণকীর্তন করায়। লোকে বিশ্বাস করে, এদের দ্বারা ক্ষতির কোনো আশঙ্কাই নেই। বাঙালি কতটা সরল তা এসব কাণ্ডকারখানা প্রকাশিত হলে বোঝা যায়।
মানুষের টাকা কৌশলে হাতিয়ে নেয়ার নামও ‘ব্যবসা’, ধর্মীয়, সামাজিক সংগঠনের নাম করে, চাঁদাবাজিও ব্যবসা। জিনের বাদশাহ সেজে ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়াও ‘ব্যবসা’ বটে। মাঝে মাঝে এরা ধরা পড়ে, জামিন পায় আবার ভোল পাল্টে নেমে পড়ে একই রাস্তায়।
বিনাশ্রমে বুদ্ধি খাটিয়ে মানুষ ঠকানোর বাণিজ্য হচ্ছে শর্টকাট রাস্তায় বড় লোক বনবার ফন্দি। সমাজে যখন বিবেক বিবেচনা নৈতিকতার স্খলন দেখা দেয় তখন এরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চাকরি করে সীমিত বেতন বা শুদ্ধ ব্যবসার কম লাভ এগুলো বিশেষ কতক লোক চায় না। তাদের টার্গেট সহজ সরল এবং মুনাফালোভী লোক। তাই তারা জাল ফেলে এবং তাদের সুবিধাজনক সময়ে গুটিয়ে নেয়।
মানুষের সঞ্চয় বিনিয়োগের জায়গা খুব কম। আগে যেমন জমিজমা পাওয়া যেত, বর্তমানে এক বিঘা ফসলি জমির দামও ৩০-৩৫ লাখ টাকা। তাই হাজার বা দু’চার লাখ টাকা নিয়ে সে চিন্তাও করা যায় না। জনসংখ্যাধিক্যের দেশে জমির স্বল্পতাও দেখা দিয়েছে। ক্ষুদ্র সঞ্চয় খাটানোর জায়গা নেই বলে সমিতি বা কোম্পানির প্রচারণায় মানুষ প্রলুব্ধ হয়। একজন বিনিয়োগকারী আরো বিনিয়োগকারী জোগাড় করে আনতে পারলে কমিশন পায়। এটা আস্তে আস্তে রুট লেভেলের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়। বিনা কাজে এই প্রতারণামূলক আয় মানবিক না অমানবিক, বৈধ না অবৈধ তা কেউ ভাবে না।
অন্যের অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করার প্রবণতা দুর্বৃত্তপরায়ণ মানুষের স্বভাব। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের দুর্বৃত্তয়ান আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্বারা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়। তারপরও তা টিকে আছে। এ উপমহাদেশে বহিঃশত্রু লুটেরা এবং দেশীয় ডাকাতদের দমন করতে পূর্বকাল থেকেই শাসকদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। ‘ধনী’ দস্যুদের কথাই ধরা যাক। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এরা একসময় দলবদ্ধ হয়ে পথে পথিক দলের সাথে মিশে যেত এবং মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তাদের দলে টেনে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে সর্বস্ব লুটে নিত এবং ঘাড়, হাত, পা ভেঙে মাটিতে পুঁতে দিত। পথিকের আত্মীয়-পরিজন কোনো দিনও জানতে পারত না তার কী পরিণতি ঘটেছে। ঠগিরা সংসারী ছিল, তাদের পরিবারপরিজন ছিল, তাদের দেখে বুঝার উপায় ছিল না তারা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর, লুটেরা। আমরা কি তথাকথিত মাল্টিপারপাস জাতীয় কিছু নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে ‘ঠগিদের’ চরিত্রই দেখতে পাই না? তারাও তো মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে সাধারণের টাকা আত্মসাৎ করে। শারীরিক খুন হয়তো সরাসরি করে না; কিন্তু নিজেরা পালিয়ে বেঁচে ভুক্তভোগী মানুষদের মানসিক যন্ত্রণা আর আহাজারিতে ভোগায়। সঞ্চয় হারানো অভাব অনটনে পর্যুদস্ত মানুষগুলোর শারীরিক অক্ষমতার দিকেও ঠেলে দেয়। এটা কি হত্যা নয়? লেখার শুরুতে যে ভদ্রলোকের মস্তিষ্কের সমস্যার কথা লিখেছিলাম, তা তো কেবল একজন ব্যক্তির কথা। এ রকম কত আছে তার হিসাব হয়নি।
অপরাধ ডালপালা বিস্তারের আগেই শিকড়সহ উল্টে ফেলতে হয়। ভদ্রবেশী দস্যুতা বন্ধ করতে সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রশাসন যদি প্রথম থেকেই হায় হায় কোম্পানির দিকে নজরদারি করে তাহলে মনে হয় ব্যাপারটা এতদূর গড়াতে পারে না। ঠগের ব্যবসা যারা করে তারাও তো ধূর্ততায় সেরা। এরা টোপ ফেলে বা ভেট দেয় মাসকাবারে, প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশালী একশ্রেণীর মানুষের মুফতে অর্থ পাওয়ার লোভ যাদের আছে, তারাই প্রোটেকশন দেয় ওই সব কর্মকাণ্ডের হোতাদের। এগুলো অজানা বা নতুন বিষয় নয়। এগুলোই হয় বা হয়ে থাকে।
লেখক : সাংবাদিক